বিশ্বাস করার স্বপক্ষে কিছু ভাল ও মন্দ কারণ ২

পূর্ব প্রকাশের পর ....

বিজ্ঞানীরাও এই পদ্ধতিতে কাজ করেন। তারাও ডাক্তারদের মত বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জটিল ও দুর্বোধ্য মহাবিশ্বকে বুঝতে চেষ্টা করেন। আচ্ছা, এখন এইসব সন্দেহ, পর্যবেক্ষণ, ইত্যাদির কথা থাক। কোন কিছু বিশ্বাস করার স্বপক্ষে আরও ভাল কিছু কারণ আছে। আমি সেইসব নিয়ে তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই। এগুলো হল ঐতিহ্য, প্রথা, বয়স্ক বা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি কর্তৃক প্রদত্ত সিদ্ধান্ত বা কর্তৃপক্ষের আদেশ এবং প্রত্যাদেশ বা ঐশী বাণী।

প্রথমে ঐতিহ্য বা প্রথার কথা বলি। কয়েক মাস আগে টেলিভিশনের এক অনুষ্ঠানে আমি ৫০ জন শিশুর সাথে গল্প করেছিলাম। খুব সচেতনভাবে এই শিশুদেরকে বাছাই করা হয়েছিল। বিভিন্ন আলাদা আলাদা ধর্ম থেকে এই শিশুদেরকে নির্বাচন করা হয়েছে। কেউ খ্রিস্টান, কেউ ইহুদী, কেউ মুসলমান কিংবা কেউ হিন্দু বা শিখ ধর্মের। উপস্থাপক তাদের ধর্মবিশ্বাস জানার জন্য প্রত্যেকের কাছে গিয়েছিলেন। তারা প্রথার কথা বলেছিল। আমিও সেই প্রথার কথা বলছি। শিশুরা তাদের বিশ্বাসের স্বপক্ষে কোন প্রমাণ দেখাতে পারেনি। কোন প্রমাণ ছাড়াই পিতা বা পিতামহের কাছ থেকে প্ওায়া ধর্মকে তারা গ্রহণ করেছে। তারা ঠিক এভাবে বলেছে-”আমরা হিন্দুরা এটা বিশ্বাস করি, মুসলমানরা বলেছে আমরা ওটা বিশ্বাস করি, খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করি অন্যকিছুতে”- এরকম।

যদিও তারা বিভিন্ন জিনিসে বিশ্বাস করে তারপরও তারা কেউ সঠিক না। উপস্থাপক এটাকেই স্বাভাবিক ভেবে নিয়েছেন। তিনি ওদেরকে নিজধর্ম নিয়ে পরস্পরের সাথে আলোচনা করতেও বললেন না। কিন্তু তাদের বিশ্বাস কোত্থেকে এসেছে এই কথা আমি জিজ্ঞাসা করতে চেয়েছিলাম। এর মূল উৎস আসলে প্রথা। তার মানে পিতামহ থেকে পিতা, পিতা থেকে সন্তান এভাবে বিশ্বাস প্রবাহিত হয়েছে। অথবা শতাব্দীকালব্যাপী হাতবদল হওয়া বই থেকে তাদের বিশ্বাস এসেছে। আর পূর্বপুরুষরা একই জিনিস শতাব্দীর পর শতাব্দী বিশ্বাস করে গেছেন। কোনরকম সন্দেহ পোষণ না করেই তারা বিশ্বাসকে মেনে নিয়েছেন। এটাকেই বলে প্রথা (Tradition)।

প্রথাকে নিয়ে একটা সাধারণ সমস্যা আছে। কতদিন আগে মূল গল্পটা তৈরি হয়েছে সেটা কোন বিষয় না। বর্তমান কাল পর্যন্ত সত্যি বা মিথ্যা যাই হোক তা প্রথার মাধ্যমে চলে এসেছে। মানুষ প্রশ্ন না করে চোখ বন্ধ রেখেই তা গ্রহণ করে এবং মেনে চলে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে তা সত্যি হয়ে গেল। কোন একটা গল্প শত কেন হাজার বছর বয়স হলেও সত্য হয়ে যায় না।

ইংল্যান্ডের বেশিরভাগ মানুষ চার্চ অব ইংল্যান্ডের দ্বারা ব্যাপ্টাইজ হয়েছে। কিন্তু এটা খ্রিস্টিয় ধর্মের একটা শাখা মাত্র। এছাড়াও আরও অনেক শাখা আছে। যেমন রাশিয়ার অর্থোডক্স, রোমান ক্যাথলিক এবং মেথোডিস্ট চার্চ। তাদের প্রত্যেকের বিশ্বাস ভিন্নরকম। এখনও ইহুদী ধর্ম এবং ইসলাম ধর্ম পরস্পরের চাইতে আলাদারকম। আবার ইহুদি ও মুসলমানদের মধ্যেও বিভিন্নতা আছে। এসব ধর্মবিশ্বাসীরা সামান্য মতপার্থক্যের কারণে যুদ্ধ করতে পিছুপা হয়না। অতএব তুমি হয়তো ভাবতে পারো যে তাদের নিজ নিজ বিশ্বাসের স্বপক্ষে সামান্য হলেও কিছু ভাল প্রমাণ আছে। কিন্তু আসল ঘটনা হল, তাদের বিশ্বাসের উৎস বিভিন্ন রকম সংস্কৃতি বা প্রথা।
আরেকটি বিশেষ ঘটনা সম্পর্কে বলি। রোমান ক্যাথলিকগণ মনে করেন মা মেরি এমনই বিশেষ সম্মানীয় ছিলেন যে তিনি মারা যেতে পারেন না। তাকে সশরীরে স্বর্গে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অন্য খ্রিস্টানরা এটা মানেন না। তারা বলেন যে মেরি অন্যান্য মানুষের মত এই পৃথিবীতেই মারা গেছেন। এই খ্রিস্টানরা এর বেশি আর কিছু বলেন না। রোমান ক্যাথলিকদের মত মা মেরিকে স্বর্গের রাণী বলেননা। মেরির সশরীরে স্বর্গারোহনের গল্পটা খুব একটা পুরনো নয়। কারণ বাইবেলে এ সম্পর্কে কোন তথ্য নেই। আসলে বাইবেলে মা মেরি সম্পর্কে খুব একটা বেশি কিছু বলা হয়নি। ষষ্ঠ শতাব্দীর আগে মা মেরির সশরীরে স্বর্গারোহনের গল্পটি ছিল না। প্রথমে এটা অন্যান্য সব গল্প যেমন ’তুষার রাজকন্যা’ গল্পটির মত তৈরি করা হয়েছিল। পরবর্তীতে কয়েকশত বছর পর এটা বিশ্বাসে পরিণত হয়েছ্। শত শত বছরব্যাপী গল্পটা প্রচলিত থাকার কারণে মানুষ একে মূল্য দিয়েছে। একটি গল্প যত পুরনো হয় মানুষ ততোই তাকে বেশি গ্রহণযোগ্য বলে মনে করে। সর্বশেষে রোমান ক্যাথলিকদের দ্বারা আনুষ্ঠানিকভাবে এই গল্পটা লিখিত হয়। এটা খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। এই তো সেদিন ১৯৫০ সালে। আমার বয়স তখন তোমার মত ছিল। লিখিত হওয়ার অর্থ এই নয় যে গল্পটা সত্যি। বরং মেরির মৃত্যুর ছয় বছর পরে যখন গল্পটা তৈরি হয় তখন যেমন বানানো ছিল, ১৯৫০ সালেও তেমন ছিল।

(অসমাপ্ত)

0/Post a Comment/Comments

Previous Post Next Post