কেন আমি নাস্তিক থেকে গেলাম - শবনম নাদিয়া -০১

কেন আমি নাস্তিক থেকে গেলাম
- শবনম নাদিয়া
(Why I remain an atheist- Shabnam Nadiya)
অনুবাদ: অগ্নি অধিরূঢ়

কৈশোরের প্রথম দিকেই আমি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলতে শুরু করি। ধর্মকে আমার নিজের কাছে অন্তসারহীন মনে হবার আগ পর্যন্ত আমি নিজেকে এ বিষয়ে নিরন্তর প্রশ্ন করেছিলাম। যখন বালিকা ছিলাম, তখন ধর্ম, আল্লাহ - এসব সম্পর্কে খুব একটা ভাবিনি। তখন পর্যন্ত ধর্ম সম্পর্কে আমার মনে এক গভীর ধারণা ছিল। অন্যান্য মানুষেরা ধর্ম সম্পর্কে যা মনে করে আমিও তাই ভাবতাম। আমি জানতাম যে আমি একজন মুসলমান, এর অর্থ আরবী জানতে হবে কারণ এটা কোরানের ভাষা, নামাজ পড়তে হবে (এটা প্রত্যেকেই করতো, তবে বেশিরভাগ সময় বয়স্ক আত্মীস্বজন যেমন দাদাভাইয়েরা, এবং বিশেষ করে পুরুষরা সপ্তাহে একদিন জুমার নামাজ পড়তো) এবং মুসলমান থাকার অর্থ ঈদ এবং শবেবরাতের অনুষ্ঠান, দারুণ সব লোভনীয় খাবার, হাতের উজ্জ্বল মেহেদী, চকচকে নতুন পোষাক এবং নতুন জুতোর ঝকমক করে ওঠা। অবশ্য আরও কিছু ছি। এসব আমরা স্কুলে শিখেছিলাম। যেমন সুরা, হাদিস, নবীর জীবনের নানা ছোট ছোট কাহিনী, পাক ও নাপাক ইত্যাদি। আমি এরকম অল্প কিছু জেনেছিলাম। জানতাম আমি ছোট মানুষ, আমি একদিন বড় হয়ে উঠবো, আর যা কিছু জানা দাকার তার সবকিছু বাবা-মা জানেন। আমি শুধু এটুকু জানতাম যে আল্লাহ নামে একজন রয়েছেন। তার নৈকট্য লাভের জন্য আমাকে ভাল আচরণ করতে হবে। কিন্তু সেই বিশেষ মুহূর্তটি যখন এল তখন তার অস্তিত্ত্বই থাকলনা। সেই সন্দেহ, সেই আত্মসন্দেহ, নিজের সাথে করা সেই আপোষ আমার মধ্যে বিশ্বাসের মতো কিছু একটাকে ধরে রাখা - ইত্যাদি অবস্থা অনেক পরে হয়েছে, ফলে অনেক কিছু হারিয়ে ফেলা বা নিজেকে খুব একা মনে করা এধরণের কোন কিছু আমার মনে হয়নি।

যেমনটা বলছিলাম বিনা প্রশ্নে সবকিছু মেনে না নেয়ার ব্যাপারটি আমার ১১-১২ বৎসরের কোন এক বসন্তের সকালে শুরু হয়েছিল। তখন আমি একটি মক্তবের ছাত্রী ছিলাম। আমার পিতামাতা আমাদেরকে বিভিন্ন পদ্ধতিতে শিক্ষিত করে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। এ লক্ষ্যে আমাকে ও ছোটভাইকে পাশের মক্তবে পাঠিয়েছিলেন। খুব ভোরে অনিচ্ছাসত্ত্বেও জেগে উঠে কায়দা হাতে নিয়ে ঘুম ঘুম চোখে আমাদের রওনা দিতে হত। তখনও আমি ফ্রক পরা ছাড়িনি। কিন্তু মক্তবে যাওয়ার জন্য আমাকে ওড়না ও সালোয়ার পড়তে হত। এক সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয়ে গিয়েছিল। তাড়াতাড়ি করার কারণে মা আমাকে নাইটি পড়া অবস্থায় মক্তবে পাঠিয়েছিলেন। ওড়না পড়িয়ে দিতে অবশ্য তিনি ভুল করেননি। আমার নাইটিটা পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত লম্বা ছিল। এ কারণে আমার মা ভেবেছিলেন সালোয়ার না পরলেও চলবে। আমি আসলে ঠিক সেই পয়েন্টটা বলতে চাচ্ছি যেখানে বলা আছে যে- আমার শরীর ঘাড় থেকে পা পর্যন্ত আবৃত থাকতে হবে এবং মাথা ঢেকে রাখতে হবে। আমার পোষাক এবং ওড়ানা এই কাজটি ঠিকমতো করেছিল। যখন মক্তবে পৌঁছালাম তখন হুজুর আমাকে ডাকলেন। বন্ধুদের সামনে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন - "তোমার জামার নিচে কি?" তারপর তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও তাদের সন্তানদের বিভিন্ন অপকীর্তির কথা চিৎকার করে বলতে লাগলেন। তিনি আমাকে তক্ষুনি মক্তব থেকে চলে যেতে এবং যদি সাহস থাকে তাহলে সঠিকভাবে পোষাক পরে আসতে বললেন। রাগ এবং লজ্জায় আমার কান গরম হয়ে গিয়েছিল। ক্লাসের সবাই আমাকে ব্যাঙ্গ করে হাসছিল। তারপর এক দৌড়ে আমি বাড়ি চলে এলাম। আমি এত বেশি লজ্জা পেয়েছিলাম যে অন্য শিশুদের সামনে আমি অপমানিত বোধ করেছিলাম। এবং সেখানে আরও একটা বিষয় ছিল, আমি নিশ্চিত না কেন, কিন্তু একটি ছোট্ট বিষয় আমি অনুভব করেছিলাম। আমার মনে হয়েছিল 'আমার জামার নিচে কি আছে' এই প্রশ্নটি হুজুর শালীনভাবে করেননি। আমার চোখ ফেটে কান্না আসছিল এবং কাতরভাবে মাকে বলেছিলাম যে আমি আর মক্তবে ফিরে যাব না। মা বিষয়টি গভীরভাবে অনুভব করেছিলেন, তাকে ধন্যবাদ যে আমাকে আর মক্তবে যাবার জন্য জোর করেননি। এই ঘটনাটিকে আমি দুটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি।

প্রথম কারণ হল-এই ঘটনা আমকে ভাবতে শিখিয়েছে। নিজের শরীর ঢাকার ধারণাটিকে আমি সতর্কভাবে বিচার করেছি, প্রশ্নবিদ্ধ করেছি। এর উত্তর কেউ যৌক্তিকভাবে আমাকে দেয়নি। আমার মনের বিভ্রান্তিকে দূর করার জন্য বাবাকে প্রশ্ন করলাম। আমার বাবা একজন শিক্ষক। প্রশ্ন করতে উৎসাহ দেয়ার জন্য তিনি প্রায়ই দীর্ঘ আলোচনা করতেন। তিনি বললেন- তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনার তাৎপর্য বুঝতে পারেন এমন মানুষের সংখ্যা খুব কম। হুজুর আমাকে বালিকা ছাড়া অন্য কিছু মনে করেননি। তার মনে হয়েছিল আমার সালোয়ার পরা উচিত। তিনি হয়তো কোন অশোভন কটাক্ষ করতে চাননি। কিন্তু যেহেতু তিনি স্বল্পশিক্ষিত ছিলেন, সেহেতু দুর্ভাগ্যবশত তিনি উপযুক্ত শব্দ ব্যবহার করতে পারেননি। তার মনে হয়েছে সালোয়ার না পরার অর্থ আমি শালীনভাবে পোষাক পরিনি। এটাই তার কাছে সঠিক মনে হয়েছে। কিন্তু আমার পা আমার পোষাক দিয়ে ঢাকা ছিল- আমি যুক্তি তুলে ধরলাম। আমি সঠিকভাবে নিজেকে আবৃত রেখেছিলাম। বাবা বলল- তাত্ত্বিকভাবে আমি সঠিক। কিন্তু সেই হুজুর যৌক্তিকভাবে চিন্তা করতে শেখেননি। বেশিরভাগ মানুষই এমন। তার কাছে আমি একজন মেয়ে ও আমার নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুযায়ী পোষাক পরা উচিত। যদি আমি তা না করি, তাহলে আমি যাই পরিনা কেন, হুজুরের কাছে তার কোন মূল্য নেই। আমি সঠিক পোষাক পরিনাই বলেই তিনি ধরে নেবেন। এই ঘটনা ও চিন্তা পদ্ধতি আমার ভিতরে এক অন্য রকমের পরিবর্তনের সূচনা ঘটালো। একটি লম্বা পোষাক পরা যদি সঠিক না হয়, তাহলে আমার ফ্রক পরাকে (যা আমার পা দুটোকে খোলা রেখে দেয়) তারা কি আরও খারাপ বলবেন না? কিন্তু আমার বয়সী অন্য মেয়েরা সবাই ফ্রক পরে। আর এটা কাউকে বিব্রত করেনি। এমনকি আমি যদি প্যান্ট পরি (ছেলেদের মত), যদিও তা আমার পা দুটোকে ঢেকে রাখে, তাহলেও তা হয়তো কাউকে বিব্রত করতে পারে। আমি এটা কিভাবে মেনে নেব? আমি বেশিরভাগ মানুষের পালিত ধর্মের অযৌক্তিকতাকে স্পষ্প দেখতে শুরু করলাম। লক্ষ্য করুন আমি মানুষের 'পালিত ধর্ম' শব্দ দুটি ব্যবহার করেছি। ধর্ম নিজে তখন পর্যন্ত আমার চোখে তার গ্রহণযোগ্যতা হারায়নি।

দ্বিতীয় কারণ হল- মক্তবে যেসব মানুষদেরকে আমরা 'বিশ্বাসের শিক্ষক' হিসেবে নিয়োজিত রেখেছি, তারা যে কত ছোট মনের মানুষ তা আমি আবিষ্কার করলাম। এদের মধ্যে কেউ কেউ স্ত্রীকে পেটায়, কেউ আবার বর্বরদের মতো করে ছোট ছেলেদের মারপিট করে। আমি আরও বুঝলাম যে স্ত্রীকে মারার আরও অন্য উপায় আছে। যেমনটা বলা হয় 'হাতে না মেরে ভাতে মারা'। যারা ধমকাধমকি করে দুর্বলকে শাসনে রাখে তারা যে খুব ভাল স্বামী তা হয়তো নয়। কিন্তু সবসময় দেখা গেছে ধর্মীয় শিক্ষকদের এইসব অপরাধকে লঘু পাপ হিসেবে দেখা হয়না। এইসব ঘটনার কারণে আমি নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করা শুরু করলাম। এই ধরণের স্বভাব যাদের তারা আল্লাহর বাণী আমাদের কাছে পৌছে দেয়, শুধুমাত্র এই কারণে কি শ্রদ্ধেয় হতে পারে? এই মানুষরা বোঝে কম, তাদের আত্মা বিভ্রান্ত, এরা আল্লাহর দেয়া জীবনকে কিছু অন্ধ নিয়ম ও প্রথার শিকলে বন্দী করে বাঁচতে চায়। তাদের অনুভূতি, উপলব্ধিকে ভালমতো বিশ্লেষণ না করেই কি তাদেরকে শ্রদ্ধেয় বলে মনে করবো? আমি সেই হুজুরের প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ করি। অন্ধত্ব আর শালীন ও অশালীনের মধ্যে পার্থক্য করতে ব্যর্থতার জন্য তাকে আমি চিরকাল মনে রাখবো। আমার কাছে মনে হয়েছে, আমি যদি কিছু নাও পরতাম, এর চাইতেও তার শব্দগুলি শতগুণ বেশি অশালীন ছিল। তার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ যে তার আচরণ, চিন্তাপদ্ধতি আমাকে প্রশ্ন করতে শিখিয়েছে। তার ব্যবহারের কারণে আমি আমার ১৪ বছরের বাড়ন্ত বয়সে সন্দেহবাদী হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু তখনও ধর্মীয় বাতাবরণে আমার বিশ্বাসকে আমি ধরে রেখেছিলাম।

মূল লেখার লিংক
অসমাপ্ত

1/Post a Comment/Comments

  1. ধর্ম প্রথার শিকল ভেঙে ফেলুক বাংলাদেশের ধর্মাক্রান্ত নারীরা। শবনমের চেতনা অনুভব করতে শিখুক অনুভূতিহীন বাংলার নারীরা। লেখককে এই লেখাটি অনুবাদ করার জন্য মনের গহীন থেকে কৃতজ্ঞতা জানাই।

    ReplyDelete

Post a Comment

Previous Post Next Post