ইসলামী আইন
শরিয়া অথবা ইসলামী আইন চারটি মূল সূত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত। একে আরবীতে 'উসুল' (Usul) বলে। বহুবচনে এটা আসল (Asl)। (ক) কোরান, (খ) মোহাম্মদের আচরণ বা সুন্নাহ/ সুন্নত, এটা আসলে বিভিন্ন পুরাতন প্রথাগুলোকে স্বীকার করে নেয়ার মাধ্যমে গৃহিত হয়েছে। (গ) বিভিন্ন ইসলামী পণ্ডিতদের দ্বারা সমর্থিত মতামতসমূহ বা ইজমা (Ijma) এবং (ঘ) বিভিন্ন তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে যুক্তিগ্রাহ্য কোন সিদ্ধান্ত বা কিয়াস (Qiyas or Kiyas)
কোরান
আমরা আগেই দেখেছি যে মুসলমানরা মনে করে কোরান হল তাদের আল্লাহ'র একেবারে নিজস্ব বক্তব্যের সংকলন। প্রথমদিকে মুসলিম জনগণের জন্য এটা কিছু বিষয় যেমন বিবাহ, তালাক, উত্তরাধিকার ইত্যাদি বিষয়ে আইন ও আদেশ প্রদান করতো। কিন্তু সাধারণ নীতি সম্পর্কে তখন কোরান কোন মন্তব্য ছিল না। বরং কোন কোন বিষয়ে কোরান বোকাটে আচরণ করেছে এবং কোন কোন বিষয়ে প্রয়োজনীয় মনোযোগ দেয়নি। এমন কি বেশ কিছু অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নকে যথাযথ গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করতেও সক্ষম হয়নি।
সুন্না
সুন্না হল জীবন যাপনের পদ্ধতি, জীবনের পথ। এটা নবীর দ্বারা কৃত বা তার বলা বিভিন্নরকম পদ্ধতি যার মাধ্যমে মুসলমানরা নিজেদের জীবনের গতিপথকে পরিচালিত করে। নবী জীবিতাবস্থায় যেসব আচরণ করতেন বা যা বলেছেন, অথবা যা করতে নিষেধ করেননি, সেগুলোই হল সুন্নাহ। সুন্নাহগুলো প্রথা, হাদীস হিসেবে গৃহিত হয়ে গেছে। কিন্তু দেখা গেছে ইসলামের প্রাথমিক যুগে হাদীসের ব্যাপক জালিয়াতি হয়েছিল। তবুও মুসলমানদের কাছে এই সুন্নাহ কোরানের পরিপূরক এবং কোরানকে সঠিকভাবে বোঝার জন্য এক অত্যাবশকীয় উপায়।
কোরানে যা কিছু যথাযথভাবে বর্ণনা করা হয় নি সেসবের ব্যাখ্যা প্রদান বা কোরান যেসব বিষয়ে নিশ্চুপ থাকে, সেইসব শূন্যস্থানগুলোকে পূরণ করার জন্য সুন্নাহ'র কোন বিকল্প নেই। কোরান ছাড়া মুসলমানরা তাদের প্রতিদিনের জীবনের বিস্তারিত প্রয়োজনগুলোকে হারিয়ে ফেলবে।
কোরান এবং সুন্নাহ হল আল্লাহ'র আদেশের প্রকাশ। এগুলো আল্লাহ'র চুড়ান্ত ও দুর্বোধ্য আদেশের সমষ্টি। কোনরকম সন্দেহ বা প্রশ্ন বা গুণগত বিচার ছাড়াই এসবকে সম্পূর্ণভাবে মানতে হবে।
কোরান এবং সুন্নাহ'র যাবতীয় অস্পষ্টতার কারণে আমাদের আজও কিছু ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের প্রয়োজন হয়। আর এই কাজ করে শরীয়ার জ্ঞান বা ফিকাহ (Fiqh), এই আইনে বিশেষজ্ঞদেরকে বলা হয় ফকিহ (Faqih)। তারা ইসলামী আইনকে ব্যাখ্যার বিভিন্ন ধারা সৃষ্টি করেছেন। এদের মধ্যে মাত্র চারটি ধারা বর্তমান কাল পর্যন্ত টিকে আছে। এদের মতগুলোকে সারা পৃথিবীর গোঁড়া ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা ব্যাবহার করেছেন। সোজাভাবে বললে এই চারটি ধারাই সমানভাবে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করা হয়।
(১) মালিক ইবনে আব্বাস (Malik Ibn Abbas) মৃত-৭৯৫: ইনি মদিনাতে বাস করতেন। সেখানে বসে থেকেই তার ভাবনাকে প্রচার করেছেন। ধারণা করা হয় তিনি মোহাম্মদের সঙ্গীদের মধ্যে সর্বশেষ জীবিত ব্যক্তি ছিলেন। তার মতবাদকে বলা হয় মুয়াত্তা (Muwatta)। আফ্রিকার মুসলমানদের মধ্যে তার মতবাদ ব্যাপকভাবে প্রচলিত। তবে মিশর, জাঞ্জিবার এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় তিনি ততোটা জনপ্রিয় নন।
(২) আবু হানিফা (Abu Hanifa)মৃত-৭৬৭: ইনি হানিফি মতধারার প্রবক্তা। জন্মেছেন ইরাকে। তার মতবাদে 'কারণ' এবং 'যুক্তি'কে একটু বেশি ছাড় দেয়া হয়েছে। ভারত এবং তুরস্কের মুসলমানরা আবু হানিফার মতবাদকে মেনে চলেন।
(৩) আল সাফী (Al-shafi) মৃত- ৮২০: ইনি জন্মগ্রহণ করেছেন ইরাকে। তাকে অপেক্ষাকৃত পরিশীলিত বলে মনে করা হয়। তিনি প্রথমে ইরাকে তার শিক্ষা প্রচার করেন। পরবর্তীতে মিশরে চলে যান। ইন্দোনেশিয়ার মুসলমানরা তার মতবাদকে মেনে চলে। তিনি নবীর সুন্নাহর উপর প্রধান গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি শরীয়ার উৎস হিসেবে হাদীসকে স্পষ্ট করে তুলেছেন।
(৪) আহমদ ইবনে হানবল (Ahmad ibn Hanbal) মৃত- ৮৫৫: জন্মগ্রহণ করেছেন ইরাকের বাগদাদে। তিনি আল সাফীর বিভিন্ন আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। নির্যাতনের দুর্ণাম সত্ত্বেও ইবনে হানবল এই মতবাদে আস্থা রাখেন যে, কোরান কারও দ্বারা তৈরি নয়। সৌদি আরবের আধুনিক ওয়াহাবিরা ইবনে হানবল এর শিক্ষাকে অনুসরণ করে থাকে।
নতুন ভাবধারা হিসেবে এই সব মতাদর্শকে যখন পরিচিত করানো হয়, তখন এই গোষ্ঠীগুলো চুলচেরা সমালোচনার বাইরে থাকতে পারে না। কোনরকম বিচার ছাড়াই পার্থিব প্রত্যাশার সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য ইসলামী আইনকে যখন মানিয়ে চলতে হয়, তখন তাকে মানবতার অপমানকে সহ্যকারী বলে চিহ্নিত হতে হয়। এইসব নিন্দা থেকে মুক্ত হবার জন্য ইসলামী আইনের প্রাজ্ঞ পণ্ডিতেরা তখন এক নির্ভুল মতাদর্শের উন্নয়ন সাধন করেন। এর নাম ইজমা (Ijma)। এটা ইসলামী আইন অথবা শরীয়ার তৃতীয় ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
অসমাপ্ত
মুক্তমনায় প্রকাশিত
Post a Comment